Bhawal Rajbari ভাওয়াল রাজবাড়ী | অবিশ্বাস্য যে ইতিহাস কল্প কাহিনীকেও হা...


ভাওয়াল রাজার সত্য ইতিহাস 

ফিরে এলেন রাজা, সেটাও আবার তার নিজের মৃত্যুর প্রায় ১যুগ পর। কল্প কাহিনীকেও হার মানায় গাজীপুরের জয়দেপুরের ভাওয়ালের মৃত রাজার সন্ন্যাসী হিসাবে আর্বিভাবের সেই ইতিহাস সত্য ঘটনা। মৃত্যুর ১ যুগ পর ভাওয়াল রাজা সন্ন্যাসী বেশে ফিরে এসে, জমিদারির অংশ ও নিজের স্বীকৃতির দাবি তুললে পরিস্থিতি কী হতে পারে, এই কাহিনি না শুনলে তা অনুমান করাও অসম্ভব। 

    


ভাওয়াল পরগনা

বিস্তৃতি, আয় ও মর্যাদার দিক থেকে ভাওয়াল এস্টেট ছিল পূর্ববঙ্গের একটি বৃহৎ ও প্রাচীন জমিদারি। জমিদার কালী নারায়ণ রায় চৌধুরীর সময়, অর্থাৎ ১৮৭৮ সালে শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণ গোত্রভুক্ত এই পরিবারটি ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে রায় ও রাজা খেতাব লাভ করে। রাজ্যের মূল কেন্দ্র জয়দেবপুর এবং এখানেই জমিদারির কাচারি বা রাজবাড়ি অবস্থিত। কালীনারায়ণের পর জমিদারির দায়িত্ব পান তার একমাত্র ছেলে রাজেন্দ্রনারায়ণ। রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী ও রানী বিলাস মনির ছিল তিন পুত্রসন্তান। তারা হলেন রণেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী, রমেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী এবং রবীন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী। ১৯০১ সালে রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর মৃত্যু হয় এবং  ১৯০৭ সালে রাণী বিলাস মনি মারা যান। এর আগে তিনি মেজোকুমার রমেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর নিকট জমিদারী অর্পন করেন।

মেজোকুমার ও বিভাবতী দেবী

মেজো কুমার রমেন্দ্রনারায়ণ ১৯০২ সালে বিয়ে করেন অপূর্ব সুন্দরী বিভাবতী দেবীকে। বিয়ের পর থেকেই ভাওয়াল রাজবাড়িতে রানী হিসেবে তিনি বিলাসবহুল জীবযাপন করছিলেন। তবুও বিভাবতী তেমন সুখী ছিলেন না। ঐতিহাসিকগণের মতে, মেজ রাজকুমার, অধিকাংশ সময় তিনি শিকারে, আনন্দ ফুর্তি করে এবং নারী সংসর্গে কাটাতেন। তার বেশ কিছু রক্ষিতা ছিল বলেও জানা যায়। বিভাবতীর মত অনিন্দ্যসুন্দরীও  তাকে মদ আর নারীসঙ্গ থেকে দূরে রাখতে পারেনি। মেজো কুমার ১৯০৫ শাল নাগাদ যৌনরোগ সিফলিসে আক্রান্ত হন। স্ত্রীর সঙ্গে দূরত্ব আগে থেকেই ছিল তার। শোনা যায় বিভাবতীও নাকি স্বামীর আচরণে বিরক্ত হয়ে বহুগমনের পথ বেছে নিয়েছিলেন। রমেন্দ্র নারায়ণের ব্যক্তিগত চিকিৎসক আশুতোষ দাসগুপ্তের সঙ্গে রানী বিভাবতীর প্রণয় ছিল বলেও দাবি করেন কোনো কোনো ইতিহাসবিদ।

১৯০৯ সালে তিনি চিকিৎসা করানোর জন্য দার্জিলিংএ গমন করেন। সেখানে  ৭ ই মে ২৫ বৎসর বয়সে তার মৃত্যু হয় বলে জানা যায়। মৃত্যুর কারণ হিসাবে বলা হয় - মৃত্যুর কারণ হিসাবে বলা হয় "বিলিয়ারিক কলিক বা গোল ব্লাডারে পাথর। দার্জিলিংয়ে ই তার শবদেহ  দাহ করা হয় এবং মে মাসের ১৮ তারিখে তার শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানও পালিত হয়। 

এদিকে বড় কুমার রণেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী ১৯১০ সালে মারা যান। রণেন্দ্র নারায়ণ মারা যাওয়ার কিছু দিন পরই ছোট কুমার রবীন্দ্র নারায়ণও ইহলোক ত্যাগ করে। তাদের সবাই ছিলেন নিঃসন্তান। ফলে তদানীন্তন উপনিবেশক শাসক ব্রিটিশদের কোর্ড অব ওয়ার্ডস কুমারদের বিধবা স্ত্রীদের পক্ষে এই জমিদারির মালিকানা হস্তান্তর করেন। 

মৃত্যু ও শবদাহ নিয়ে সংশয়

মেজো কুমার কখন মারা গিয়েছিলেন? সন্ধ্যায় নাকি মাঝরাতে?

স্টপ অ্যাসাইড বাড়ির দারোয়ানসহ অনেকেই বলেছেন, মেজো কুমার সন্ধ্যায় মারা গিয়েছিলেন। অথচ মেজো রানী ও তার ভাই সত্যেন্দ্র সবসময় বলে এসেছেন মেজো কুমার মাঝরাতে মারা গিয়েছিলেন, এখানে একটি রহস্যের সৃষ্টি হয় । পরদিন, ৮ই মে দার্জিলিঙেই মেজো কুমারের শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয়। ভাওয়ালরাজার গল্পের মূল রহস্যের শুরুটা হয় এখান থেকেই।

 

কোনো কোনো প্রত্যক্ষদর্শীর মতে,  সেদিন প্রচণ্ড শিলাবৃষ্টি হয়েছিল। মেজো কুমারের দেহটা শ্মশানের বাইরে রাখা ছিল, কাঠকয়লা দিয়ে মুড়িয়ে। ঐ সময়ে শ্মশানে চিতা প্রজ্জ্বলিত করার ঠিক আগমুহূর্তে হঠাৎ শিলাবৃষ্টি শুরু হয়। তখন শেষকৃত্যে অংশ নেয়া ব্যক্তিরা শিলাবৃষ্টি হতে বাঁচার জন্য ঢুকে পড়েছিল একটি  চাতালের ভেতরে। প্রায় ঘন্টাখানেক পর যখন বৃষ্টি থামলো, তখন রমেন্দ্র নারায়ণের মৃতদেহটা খুঁজে পাওয়া গেল না আর! যে কয়জন ছিলেন সেখানে উপস্থিত, তারা বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে মেজো কুমারের মৃত দেহ না পেয়ে হাল ছেড়ে দিলেন। শ্মশানের শেয়াল কুকুরে মৃতদেহ নিয়ে গেছে ভেবে তারা চলে গেলেন শেষমেশ। ১০ মে সকালে মেজো কুমারের মৃত্যুর খবর টেলিগ্রাম করে সবাই দার্জিলিং ত্যাগ করে জয়দেবপুরের উদ্দেশে রওনা করেন।

১৮ মে মেজো কুমারের শ্রাদ্ধ করা হয়েছিল। এসময় গুজব ছড়িয়ে গেল মেজো কুমার রমেন্দ্রনারায়ণের মৃতদেহের শ্রাদ্ধ নাকি ঠিকভাবে করা হয়নি। কোনোমতে গুজব এড়িয়ে শ্রাদ্ধ করা হলেও গুজবটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ল। এই গুজবটি ভাওয়াল রাজার বোন জ্যোতির্ময়ীর কানেও পৌঁছায়।

 

সন্ন্যাসী রুপে রাজার আবির্ভাব

 

প্রায় ১২ বছর পর অর্থাৎ  ১৯২১ সালে হঠাৎ চারিদিকে গুঞ্জন উঠে,  সন্ন্যাসীর বেশে রাজা রমেন্দ্র নারায়ণ ফিরে এসেছেন। ঢাকার বাকল্যান্ড বাঁধ এলাকায় সর্বাঙ্গে ছাই মাখা জটাধারী এক সুদর্শন সন্ন্যাসীর দেখা পাওয়া গেল। তার চেহারা অবিকল রমেন্দ্র নারায়ণের মতো! যারা রমেন্দ্র নারায়ণকে দেখেছে, তারা ভূত দেখার মতো চমকে ওঠলো এই সন্ন্যাসীকে দেখে। এক কান দুই কান হয়ে খবরটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগলো না খুব বেশি। ভাওয়াল এস্টেটেও এই খবর গিয়ে পৌঁছে গেলো। কাশিমপুরের জমিদার অতুল প্রসাদ রায়চৌধুরী তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলেন। 

খবর শুনে দলবেঁধে তাকে দেখতে এলেন এলাকার মানুষ। মৃত্যুর বারো বছর পরে মেজো কুমার ফিরে এসেছেন, এ তো চাট্টেখানি কথা নয়! খবর দেয়া হলো রমেন্দ্র নারায়ণের ছোট বোন জ্যোতির্ময়ী দেবীকে। সন্ন্যাসীকে দেখেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন জ্যোতির্ময়ী। একদম অবিকল তার মেজো ভাইয়ের মতো দেখতে এই লোক! শুধু জটাধরা চুল বাদে পুরো অবয়বটাই যেন রমেন্দ্র নারায়ণের। খালি গায়ের সন্ন্যাসীকে ভালো করে পরখ করলেন জ্যোতির্ময়ী, শিকারে গিয়ে কয়েকবার আঘাত পেয়েছিলেন রমেন্দ্র নারায়ণ, এছাড়াও শরীরে ছিল জন্মদাগ। সেই হাত, পা, নাক, মুখ, গায়ের রঙ, গলার স্বর, পায়ের ক্ষত!

জ্যোতির্ময়ী লক্ষ করেন তার ভাইয়ের মতো সন্ন্যাসীরও খাওয়ার সময়  তর্জনি আলগা হয়ে যায়, জিহ্বা বেরিয়ে আসে। জ্যোতির্ময়ী ভাইয়ের আগের একটি ছবি সন্ন্যাসীর সামনে এনে ধরেন। দুজনের চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়তে থাকে। মিলিয়ে দেখা হলো সেগুলো, শতভাগ মিলে গেল সব! 

কয়েক এলাকার জমিদারেরা মিলে বসলেন আলোচনায়, একটা কিছু সিদ্ধান্ত তো নিতে হবে এই সন্ন্যাসীর ব্যাপারে। এর পর ১৯২১ সালের ১২ এপ্রিল মেজোকুমারের পুরোনো কিছু অনুসারী সন্ন্যাসীকে নিয়ে গেলেন ভাওয়াল এস্টেটের রাজবাড়ির সামনে, তাকে ঘিরে আছে উৎসুক জনতা।  শুরু হলো প্রশ্নোত্তর পর্ব। সন্ন্যাসী মনে করতে পারলেন তার দুধ মায়ের নাম, সেটা রাজপরিবারের বাইরে আর কেউই জানতো না। পরের কয়েক দিনে আত্মীয়রা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, এই ব্যক্তিই কুমার রমেন্দ্রনারায়ণ।

রাজবাড়ির চিকিৎসক আশুতোষ দাসগুপ্ত ছিলেন সেখানে, তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, দার্জিলিঙে আসলে কি হয়েছিল? প্রতিটা ঘটনার সঠিক জবাব দিয়ে গেলেন সেই সন্ন্যাসী। ইনিই যে মেজো কুমার রমেন্দ্র নারায়ণ, সেটা নিয়ে কারো আর সন্দেহ রইলো না।

সন্ন্যাসী দাবি করেন, তিনি দার্জিলিং-এ অসুস্থ হয়ে পড়ার আগের কথা মনে করতে পারেন না। জঙ্গলে নাগা সন্ন্যাসী সাধু ধর্মদাস তাকে বৃষ্টিভেজা অবস্থায় খুঁজে পায়, এবং সেবা করে বাঁচিয়ে তুলে। সেই থেকে নাগা সন্ন্যাসীকে গুরু মেনে তিনি সন্ন্যাস ব্রত গ্রহণ করেন।

প্রমাণ যত অকাট্যই থাক, মেজকুমারকে মেনে নেয়া গুটিকয়েক লোকের জন্য সম্ভব ছিল না। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রমেন্দ্র নারায়ণের স্ত্রী বিভাবতীর ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি। কারণ, তিনি ইতোমধ্যে মেজকুমারের জীবন বীমার ৩০ হাজার টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেছেন। রাজা রমেন্দ্র নারায়ণের বোন  

 

মামলা

সারা বাংলাদেশে তথা ভারতব্যাপী চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী ও বিশ শতকের প্রচার মাধ্যমে অন্যতম আলোচিত ঘটনা ছিল " ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলা"।

১৯৩০ সালের এপ্রিলেরর ২৪ তারিখে বিভাবতী দেবী ও অন্যান্য মালিকদের বিরুদ্ধে ভাওয়াল রাজবাড়ির সম্পত্তির অধিকার চেয়ে প্রথম মামলা করেন।  বিচার কার্য শুরু হয় ১৯৩৩ সালের নভেম্বর ৩০ তারিখে।

কোর্টে রাজা দাবি করেন যে, তিনি তাঁর শ্যালক সত্যেন্দ্রনাথয়ের ষড়যন্ত্রের শিকার। সত্যেন্দ্রনাথ তার সন্তানহীনা বোনের সমর্থনে জমিদারি নিয়ন্ত্রণ করার পরিকল্পনা করে।  ষড়যন্ত্র পরিকল্পনায় সহযোগী ছিলেন পারিবারিক চিকিৎসক আশুতোষ দাশগুপ্ত। রোগমুক্তির কথা বলে তাঁকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে দার্জিলিংয়ে নিয়ে তাঁকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছিল এবং রাতের অন্ধকারে তাঁকে দ্রুত দাহ করতে চেয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ শিলাঝড় শুরু হলে যেসব ভাড়া করা ডোম রাজাকে পোড়াতে নিয়ে গিয়েছিল তারা তাঁকে ফেলে রেখে চলে যায়।

ঐ সময় একদল নাগা সন্ন্যাসী শ্মশানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তারা রাজাকে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে। সন্ন্যাসীরা তাদের ডেরায় রাজাকে বহন করে নিয়ে যায় এবং সেবাশুশ্রূষা করে। সেবায় রাজা আরোগ্য লাভ করেন বটে, কিন্তু স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। নাগা সন্ন্যাসীদের সঙ্গে তিনি ১৯০৯ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত ভ্রাম্যমাণ জীবনযাপন করেন। ১৯২০ সালে যখন ওদের সঙ্গে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় পৌঁছেন তখন আকস্মিকভাবে তিনি লুপ্ত স্মৃতি ফিরে পান।

উভয় পক্ষ থেকে কয়েকশ সাক্ষী হাজির করা হয়। তাদের অনেকের সাক্ষ্য ছিলো পরস্পরবিরোধী।  উভয় পক্ষের সমাপনী যুক্তিতর্ক চলে ছয় সপ্তাহ ধরে। মামলার রায় দেয়ার পূর্বে শুনানি মুলতবি করা হয় ১৯৩৬ সালের মে মাসের ২০ তারিখে।

বিচারক পান্নাবল বসু তিন মাস ধরে চূড়ান্ত রায় নিয়ে কাজ করেন। ১৯৩৬ সালের আগস্ট ২৪ তারিখে তিনি বিস্তারিত ব্যাখ্যা সহ রায় প্রদান করেন, এবং সন্ন্যাসীর পক্ষে রায় দেন। এসময় মামলার রায় জানতে বিশাল জনসমাগম হয়।

দ্বিতীয় মামলা

ভাওয়াল রাজবাড়ি রমেন্দ্রনারায়ণের সম্পত্তির ভাগ থেকে দাবিদার সন্ন্যাসীকে টাকা নিতে অনুমতি দেয়া হয়। তিনি অন্যান্য বিষয়ের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত অর্থ গ্রহণ স্থগিত রাখেন।

তবে বিভাবতী দেবী হাল ছাড়তে রাজি হননি এবং মামলার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন । এর পর শুরু হয়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ফলে মামলার আপিল ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত বন্ধ থাকে। ঐ বছর বিভাবতী দেবীর আইনজীবীরা হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিলে আপিল করে।  ১৯৪৫ সালে শুনানি শুরু হয়।  লর্ড থাঙ্কের্টন, লর্ড হার্বার্ট ডু পার্স্ক, এবং স্যার চেতুর মাধবন আপিলের বিচার করেন। ২৮ দিন ধরে শুনানি চলে। ১৯৪৬ সালের জুলাই ৩০ তারিখে বিচারকেরা আপিলের বিপক্ষে রায় দেন, এবং আপিল নাকচ করে দেন। পরের দিন কলকাতায় টেলিগ্রাফ মারফত মামলার রায় জানানো হয়।

সংস্কৃতিতে সন্ন্যাসী মামলা

ভাওয়াল রাজার কথিত মৃত্যু, মৃত্যুর ১২ বছর পর সন্ন্যাসী বেশে প্রত্যাবর্তন ও শতাব্দীর আলোচিত মামলায় বিজয়।  এসব নিয়ে স্থানীয় মানুষের মুখে মুখে রয়েছে নানা ধরণের গল্প। সেসব ইতিহাসিক গল্প স্থান পেয়েছে নাটক সিনেমাতেও।

ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলাটি এতই উত্তেজনাপূর্ণ ছিল যে, মামলা যতই গড়াতে থাকে ততই দেশের সকল পত্র-পত্রিকায় নানা মনগড়া মন্তব্য ও রসালো কাহিনী প্রকাশ পেতে থাকে। অধিকন্তু, জনতার কৌতূহল মেটাতে অসংখ্য প্রচারপত্র, বিজ্ঞপ্তি ও কাহিনী ছাপা হতে থাকে। ১৯৩৭ সালে এই মামলার নিষ্পত্তি পর্যন্ত এবং পরেও ভাওয়াল সন্ন্যাসী বহুবছর ধরে গীত, গাথা, নাটক, থিয়েটার, যাত্রা ও সিনেমার উপজীব্যে পর্যবসিত হয়।

 পীযূষ বসু পরিচালিত,উত্তম কুমার,সুপ্রিয়া দেবী,তরুণ কুমার অভিনীত রাজা রমেন্দ্রনারায়ণ রায়ের জীবন, জীবনবসান ও তার প্রত্যাবর্তনকে কেন্দ্র করে ১৯৭৫ সালে তৈরি একটি ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্র হলো "সন্ন্যাসী রাজা" এবং সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত, যিশু সেনগুপ্ত, অপর্ণা সেন ও জয়া আহসান অভিনীত রাজা রমেন্দ্রনারায়ণ রায়ের জীবন, জীবনাবসান ও তার প্রত্যাবর্তনকে কেন্দ্র করে ২০১৮ সালে তৈরি একটি ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্র হলো "এক যে ছিল রাজা"। 

ভাওয়াল রাজবাড়ী কিভাবে

ভাওয়াল রাজবাড়ী যেতে চাইলে দেশের যেকোন স্থান হতে প্রথমে গাজীপুর চৌরাস্তা চলে আসুন। ঢাকা থেকে বাস বা নিজস্ব পরিবহনে গাজীপুর চৌরাস্তা আসতে পারবেন। গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে ডান দিকে মোড় নিয়ে শিবপুর মোড় হয়ে জয়দেবপুর-রাজবাড়ী সড়ক ধরে পুর্ব দিকে এগিয়ে গেলে ভাওয়াল রাজবাড়ী পৌঁছে যাবেন। এছাড়া গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে যেকোন সিএনজিওয়ালাকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের কথা বললে ভাওয়াল রাজবাড়ী আসতে পারবেন। আর ট্রেনে করে জয়দেবপুর রেলওয়ে ষ্টেশন নেমে রিকশা ভাড়া নিয়ে রাজবাড়ী পৌঁছানো যায়।

ভাওয়াল পরগনা

বিস্তৃতি, আয় ও মর্যাদার দিক থেকে ভাওয়াল এস্টেট ছিল পূর্ববঙ্গের একটি বৃহৎ ও প্রাচীন জমিদারি। জমিদার কালী নারায়ণ রায় চৌধুরীর সময়, অর্থাৎ ১৮৭৮ সালে শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণ গোত্রভুক্ত এই পরিবারটি ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে রায় ও রাজা খেতাব লাভ করে। রাজ্যের মূল কেন্দ্র জয়দেবপুর এবং এখানেই জমিদারির কাচারি বা রাজবাড়ি অবস্থিত। কালীনারায়ণের পর জমিদারির দায়িত্ব পান তার একমাত্র ছেলে রাজেন্দ্রনারায়ণ। রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী ও রানী বিলাস মনির ছিল তিন পুত্রসন্তান। তারা হলেন রণেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী, রমেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী এবং রবীন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী। ১৯০১ সালে রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর মৃত্যু হয় এবং  ১৯০৭ সালে রাণী বিলাস মনি মারা যান। এর আগে তিনি মেজোকুমার রমেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর নিকট জমিদারী অর্পন করেন।

মেজোকুমার ও বিভাবতী দেবী

মেজো কুমার রমেন্দ্রনারায়ণ ১৯০২ সালে বিয়ে করেন অপূর্ব সুন্দরী বিভাবতী দেবীকে। বিয়ের পর থেকেই ভাওয়াল রাজবাড়িতে রানী হিসেবে তিনি বিলাসবহুল জীবযাপন করছিলেন। তবুও বিভাবতী তেমন সুখী ছিলেন না। ঐতিহাসিকগণের মতে, মেজ রাজকুমার, অধিকাংশ সময় তিনি শিকারে, আনন্দ ফুর্তি করে এবং নারী সংসর্গে কাটাতেন। তার বেশ কিছু রক্ষিতা ছিল বলেও জানা যায়। বিভাবতীর মত অনিন্দ্যসুন্দরীও  তাকে মদ আর নারীসঙ্গ থেকে দূরে রাখতে পারেনি। মেজো কুমার ১৯০৫ শাল নাগাদ যৌনরোগ সিফলিসে আক্রান্ত হন। স্ত্রীর সঙ্গে দূরত্ব আগে থেকেই ছিল তার। শোনা যায় বিভাবতীও নাকি স্বামীর আচরণে বিরক্ত হয়ে বহুগমনের পথ বেছে নিয়েছিলেন। রমেন্দ্র নারায়ণের ব্যক্তিগত চিকিৎসক আশুতোষ দাসগুপ্তের সঙ্গে রানী বিভাবতীর প্রণয় ছিল বলেও দাবি করেন কোনো কোনো ইতিহাসবিদ।

১৯০৯ সালে তিনি চিকিৎসা করানোর জন্য দার্জিলিংএ গমন করেন। সেখানে  ৭ ই মে ২৫ বৎসর বয়সে তার মৃত্যু হয় বলে জানা যায়। মৃত্যুর কারণ হিসাবে বলা হয় - মৃত্যুর কারণ হিসাবে বলা হয় "বিলিয়ারিক কলিক বা গোল ব্লাডারে পাথর। দার্জিলিংয়ে ই তার শবদেহ  দাহ করা হয় এবং মে মাসের ১৮ তারিখে তার শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানও পালিত হয়। 

এদিকে বড় কুমার রণেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী ১৯১০ সালে মারা যান। রণেন্দ্র নারায়ণ মারা যাওয়ার কিছু দিন পরই ছোট কুমার রবীন্দ্র নারায়ণও ইহলোক ত্যাগ করে। তাদের সবাই ছিলেন নিঃসন্তান। ফলে তদানীন্তন উপনিবেশক শাসক ব্রিটিশদের কোর্ড অব ওয়ার্ডস কুমারদের বিধবা স্ত্রীদের পক্ষে এই জমিদারির মালিকানা হস্তান্তর করেন। 

মৃত্যু ও শবদাহ নিয়ে সংশয়

মেজো কুমার কখন মারা গিয়েছিলেন? সন্ধ্যায় নাকি মাঝরাতে?

স্টপ অ্যাসাইড বাড়ির দারোয়ানসহ অনেকেই বলেছেন, মেজো কুমার সন্ধ্যায় মারা গিয়েছিলেন। অথচ মেজো রানী ও তার ভাই সত্যেন্দ্র সবসময় বলে এসেছেন মেজো কুমার মাঝরাতে মারা গিয়েছিলেন, এখানে একটি রহস্যের সৃষ্টি হয় । পরদিন, ৮ই মে দার্জিলিঙেই মেজো কুমারের শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয়। ভাওয়ালরাজার গল্পের মূল রহস্যের শুরুটা হয় এখান থেকেই।

 

কোনো কোনো প্রত্যক্ষদর্শীর মতে,  সেদিন প্রচণ্ড শিলাবৃষ্টি হয়েছিল। মেজো কুমারের দেহটা শ্মশানের বাইরে রাখা ছিল, কাঠকয়লা দিয়ে মুড়িয়ে। ঐ সময়ে শ্মশানে চিতা প্রজ্জ্বলিত করার ঠিক আগমুহূর্তে হঠাৎ শিলাবৃষ্টি শুরু হয়। তখন শেষকৃত্যে অংশ নেয়া ব্যক্তিরা শিলাবৃষ্টি হতে বাঁচার জন্য ঢুকে পড়েছিল একটি  চাতালের ভেতরে। প্রায় ঘন্টাখানেক পর যখন বৃষ্টি থামলো, তখন রমেন্দ্র নারায়ণের মৃতদেহটা খুঁজে পাওয়া গেল না আর! যে কয়জন ছিলেন সেখানে উপস্থিত, তারা বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে মেজো কুমারের মৃত দেহ না পেয়ে হাল ছেড়ে দিলেন। শ্মশানের শেয়াল কুকুরে মৃতদেহ নিয়ে গেছে ভেবে তারা চলে গেলেন শেষমেশ। ১০ মে সকালে মেজো কুমারের মৃত্যুর খবর টেলিগ্রাম করে সবাই দার্জিলিং ত্যাগ করে জয়দেবপুরের উদ্দেশে রওনা করেন।

১৮ মে মেজো কুমারের শ্রাদ্ধ করা হয়েছিল। এসময় গুজব ছড়িয়ে গেল মেজো কুমার রমেন্দ্রনারায়ণের মৃতদেহের শ্রাদ্ধ নাকি ঠিকভাবে করা হয়নি। কোনোমতে গুজব এড়িয়ে শ্রাদ্ধ করা হলেও গুজবটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ল। এই গুজবটি ভাওয়াল রাজার বোন জ্যোতির্ময়ীর কানেও পৌঁছায়।

 

সন্ন্যাসী রুপে রাজার আবির্ভাব

 

প্রায় ১২ বছর পর অর্থাৎ  ১৯২১ সালে হঠাৎ চারিদিকে গুঞ্জন উঠে,  সন্ন্যাসীর বেশে রাজা রমেন্দ্র নারায়ণ ফিরে এসেছেন। ঢাকার বাকল্যান্ড বাঁধ এলাকায় সর্বাঙ্গে ছাই মাখা জটাধারী এক সুদর্শন সন্ন্যাসীর দেখা পাওয়া গেল। তার চেহারা অবিকল রমেন্দ্র নারায়ণের মতো! যারা রমেন্দ্র নারায়ণকে দেখেছে, তারা ভূত দেখার মতো চমকে ওঠলো এই সন্ন্যাসীকে দেখে। এক কান দুই কান হয়ে খবরটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগলো না খুব বেশি। ভাওয়াল এস্টেটেও এই খবর গিয়ে পৌঁছে গেলো। কাশিমপুরের জমিদার অতুল প্রসাদ রায়চৌধুরী তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলেন। 

খবর শুনে দলবেঁধে তাকে দেখতে এলেন এলাকার মানুষ। মৃত্যুর বারো বছর পরে মেজো কুমার ফিরে এসেছেন, এ তো চাট্টেখানি কথা নয়! খবর দেয়া হলো রমেন্দ্র নারায়ণের ছোট বোন জ্যোতির্ময়ী দেবীকে। সন্ন্যাসীকে দেখেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন জ্যোতির্ময়ী। একদম অবিকল তার মেজো ভাইয়ের মতো দেখতে এই লোক! শুধু জটাধরা চুল বাদে পুরো অবয়বটাই যেন রমেন্দ্র নারায়ণের। খালি গায়ের সন্ন্যাসীকে ভালো করে পরখ করলেন জ্যোতির্ময়ী, শিকারে গিয়ে কয়েকবার আঘাত পেয়েছিলেন রমেন্দ্র নারায়ণ, এছাড়াও শরীরে ছিল জন্মদাগ। সেই হাত, পা, নাক, মুখ, গায়ের রঙ, গলার স্বর, পায়ের ক্ষত!

জ্যোতির্ময়ী লক্ষ করেন তার ভাইয়ের মতো সন্ন্যাসীরও খাওয়ার সময়  তর্জনি আলগা হয়ে যায়, জিহ্বা বেরিয়ে আসে। জ্যোতির্ময়ী ভাইয়ের আগের একটি ছবি সন্ন্যাসীর সামনে এনে ধরেন। দুজনের চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়তে থাকে। মিলিয়ে দেখা হলো সেগুলো, শতভাগ মিলে গেল সব! 

কয়েক এলাকার জমিদারেরা মিলে বসলেন আলোচনায়, একটা কিছু সিদ্ধান্ত তো নিতে হবে এই সন্ন্যাসীর ব্যাপারে। এর পর ১৯২১ সালের ১২ এপ্রিল মেজোকুমারের পুরোনো কিছু অনুসারী সন্ন্যাসীকে নিয়ে গেলেন ভাওয়াল এস্টেটের রাজবাড়ির সামনে, তাকে ঘিরে আছে উৎসুক জনতা।  শুরু হলো প্রশ্নোত্তর পর্ব। সন্ন্যাসী মনে করতে পারলেন তার দুধ মায়ের নাম, সেটা রাজপরিবারের বাইরে আর কেউই জানতো না। পরের কয়েক দিনে আত্মীয়রা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, এই ব্যক্তিই কুমার রমেন্দ্রনারায়ণ।

রাজবাড়ির চিকিৎসক আশুতোষ দাসগুপ্ত ছিলেন সেখানে, তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, দার্জিলিঙে আসলে কি হয়েছিল? প্রতিটা ঘটনার সঠিক জবাব দিয়ে গেলেন সেই সন্ন্যাসী। ইনিই যে মেজো কুমার রমেন্দ্র নারায়ণ, সেটা নিয়ে কারো আর সন্দেহ রইলো না।

সন্ন্যাসী দাবি করেন, তিনি দার্জিলিং-এ অসুস্থ হয়ে পড়ার আগের কথা মনে করতে পারেন না। জঙ্গলে নাগা সন্ন্যাসী সাধু ধর্মদাস তাকে বৃষ্টিভেজা অবস্থায় খুঁজে পায়, এবং সেবা করে বাঁচিয়ে তুলে। সেই থেকে নাগা সন্ন্যাসীকে গুরু মেনে তিনি সন্ন্যাস ব্রত গ্রহণ করেন।

প্রমাণ যত অকাট্যই থাক, মেজকুমারকে মেনে নেয়া গুটিকয়েক লোকের জন্য সম্ভব ছিল না। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রমেন্দ্র নারায়ণের স্ত্রী বিভাবতীর ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি। কারণ, তিনি ইতোমধ্যে মেজকুমারের জীবন বীমার ৩০ হাজার টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেছেন। রাজা রমেন্দ্র নারায়ণের বোন  

 

মামলা

সারা বাংলাদেশে তথা ভারতব্যাপী চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী ও বিশ শতকের প্রচার মাধ্যমে অন্যতম আলোচিত ঘটনা ছিল " ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলা"।

১৯৩০ সালের এপ্রিলেরর ২৪ তারিখে বিভাবতী দেবী ও অন্যান্য মালিকদের বিরুদ্ধে ভাওয়াল রাজবাড়ির সম্পত্তির অধিকার চেয়ে প্রথম মামলা করেন।  বিচার কার্য শুরু হয় ১৯৩৩ সালের নভেম্বর ৩০ তারিখে।

কোর্টে রাজা দাবি করেন যে, তিনি তাঁর শ্যালক সত্যেন্দ্রনাথয়ের ষড়যন্ত্রের শিকার। সত্যেন্দ্রনাথ তার সন্তানহীনা বোনের সমর্থনে জমিদারি নিয়ন্ত্রণ করার পরিকল্পনা করে।  ষড়যন্ত্র পরিকল্পনায় সহযোগী ছিলেন পারিবারিক চিকিৎসক আশুতোষ দাশগুপ্ত। রোগমুক্তির কথা বলে তাঁকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে দার্জিলিংয়ে নিয়ে তাঁকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছিল এবং রাতের অন্ধকারে তাঁকে দ্রুত দাহ করতে চেয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ শিলাঝড় শুরু হলে যেসব ভাড়া করা ডোম রাজাকে পোড়াতে নিয়ে গিয়েছিল তারা তাঁকে ফেলে রেখে চলে যায়।

ঐ সময় একদল নাগা সন্ন্যাসী শ্মশানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তারা রাজাকে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে। সন্ন্যাসীরা তাদের ডেরায় রাজাকে বহন করে নিয়ে যায় এবং সেবাশুশ্রূষা করে। সেবায় রাজা আরোগ্য লাভ করেন বটে, কিন্তু স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। নাগা সন্ন্যাসীদের সঙ্গে তিনি ১৯০৯ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত ভ্রাম্যমাণ জীবনযাপন করেন। ১৯২০ সালে যখন ওদের সঙ্গে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় পৌঁছেন তখন আকস্মিকভাবে তিনি লুপ্ত স্মৃতি ফিরে পান।

উভয় পক্ষ থেকে কয়েকশ সাক্ষী হাজির করা হয়। তাদের অনেকের সাক্ষ্য ছিলো পরস্পরবিরোধী।  উভয় পক্ষের সমাপনী যুক্তিতর্ক চলে ছয় সপ্তাহ ধরে। মামলার রায় দেয়ার পূর্বে শুনানি মুলতবি করা হয় ১৯৩৬ সালের মে মাসের ২০ তারিখে।

বিচারক পান্নাবল বসু তিন মাস ধরে চূড়ান্ত রায় নিয়ে কাজ করেন। ১৯৩৬ সালের আগস্ট ২৪ তারিখে তিনি বিস্তারিত ব্যাখ্যা সহ রায় প্রদান করেন, এবং সন্ন্যাসীর পক্ষে রায় দেন। এসময় মামলার রায় জানতে বিশাল জনসমাগম হয়।

দ্বিতীয় মামলা

ভাওয়াল রাজবাড়ি রমেন্দ্রনারায়ণের সম্পত্তির ভাগ থেকে দাবিদার সন্ন্যাসীকে টাকা নিতে অনুমতি দেয়া হয়। তিনি অন্যান্য বিষয়ের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত অর্থ গ্রহণ স্থগিত রাখেন।

তবে বিভাবতী দেবী হাল ছাড়তে রাজি হননি এবং মামলার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন । এর পর শুরু হয়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ফলে মামলার আপিল ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত বন্ধ থাকে। ঐ বছর বিভাবতী দেবীর আইনজীবীরা হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিলে আপিল করে।  ১৯৪৫ সালে শুনানি শুরু হয়।  লর্ড থাঙ্কের্টন, লর্ড হার্বার্ট ডু পার্স্ক, এবং স্যার চেতুর মাধবন আপিলের বিচার করেন। ২৮ দিন ধরে শুনানি চলে। ১৯৪৬ সালের জুলাই ৩০ তারিখে বিচারকেরা আপিলের বিপক্ষে রায় দেন, এবং আপিল নাকচ করে দেন। পরের দিন কলকাতায় টেলিগ্রাফ মারফত মামলার রায় জানানো হয়।

সংস্কৃতিতে সন্ন্যাসী মামলা

ভাওয়াল রাজার কথিত মৃত্যু, মৃত্যুর ১২ বছর পর সন্ন্যাসী বেশে প্রত্যাবর্তন ও শতাব্দীর আলোচিত মামলায় বিজয়।  এসব নিয়ে স্থানীয় মানুষের মুখে মুখে রয়েছে নানা ধরণের গল্প। সেসব ইতিহাসিক গল্প স্থান পেয়েছে নাটক সিনেমাতেও।

ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলাটি এতই উত্তেজনাপূর্ণ ছিল যে, মামলা যতই গড়াতে থাকে ততই দেশের সকল পত্র-পত্রিকায় নানা মনগড়া মন্তব্য ও রসালো কাহিনী প্রকাশ পেতে থাকে। অধিকন্তু, জনতার কৌতূহল মেটাতে অসংখ্য প্রচারপত্র, বিজ্ঞপ্তি ও কাহিনী ছাপা হতে থাকে। ১৯৩৭ সালে এই মামলার নিষ্পত্তি পর্যন্ত এবং পরেও ভাওয়াল সন্ন্যাসী বহুবছর ধরে গীত, গাথা, নাটক, থিয়েটার, যাত্রা ও সিনেমার উপজীব্যে পর্যবসিত হয়।

 পীযূষ বসু পরিচালিত,উত্তম কুমার,সুপ্রিয়া দেবী,তরুণ কুমার অভিনীত রাজা রমেন্দ্রনারায়ণ রায়ের জীবন, জীবনবসান ও তার প্রত্যাবর্তনকে কেন্দ্র করে ১৯৭৫ সালে তৈরি একটি ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্র হলো "সন্ন্যাসী রাজা" এবং সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত, যিশু সেনগুপ্ত, অপর্ণা সেন ও জয়া আহসান অভিনীত রাজা রমেন্দ্রনারায়ণ রায়ের জীবন, জীবনাবসান ও তার প্রত্যাবর্তনকে কেন্দ্র করে ২০১৮ সালে তৈরি একটি ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্র হলো "এক যে ছিল রাজা"।

 

ভাওয়াল রাজবাড়ী কিভাবে

ভাওয়াল রাজবাড়ী যেতে চাইলে দেশের যেকোন স্থান হতে প্রথমে গাজীপুর চৌরাস্তা চলে আসুন। ঢাকা থেকে বাস বা নিজস্ব পরিবহনে গাজীপুর চৌরাস্তা আসতে পারবেন। গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে ডান দিকে মোড় নিয়ে শিবপুর মোড় হয়ে জয়দেবপুর-রাজবাড়ী সড়ক ধরে পুর্ব দিকে এগিয়ে গেলে ভাওয়াল রাজবাড়ী পৌঁছে যাবেন। এছাড়া গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে যেকোন সিএনজিওয়ালাকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের কথা বললে ভাওয়াল রাজবাড়ী আসতে পারবেন। আর ট্রেনে করে জয়দেবপুর রেলওয়ে ষ্টেশন নেমে রিকশা ভাড়া নিয়ে রাজবাড়ী পৌঁছানো যায়।

কোথায় থাকবেন

ঢাকা থেকে ভাওয়াল রাজবাড়ী সারাদিন ঘুরে সন্ধ্যার মধ্যেই আবার ঢাকায় ফিরে আসা যায়। তবে প্রয়োজনে রাত্রি যাপনের জন্য ছুটি, সারাহ, নক্ষত্র বাড়ি, গ্রিন ভিউ রিসোর্ট, সোহাগ পল্লী, স্প্রিং ভ্যালী, জল ও জঙ্গলের কাব্য ইত্যাদি রিসোর্টকে বেছে নিতে পারেন।

গাজীপুরের অন্যান্য দর্শনীয় স্থান

ভাওয়াল রাজবাড়ী থেকে মাত্র ১ কিলোমিটার দূরত্বে রয়েছে ভাওয়াল রাজশ্মশানেশ্বরী নামের একটি শ্মশান, যেখানে ভাওয়াল রাজপরিবারের সদস্যদের শব দাহ্য করা হত। এছাড়াও হাতে সময় থাকলে ঘুরে আসতে পারেন ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান, নুহাশ পল্লী এবং বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের মতো জায়গা থেকে।

No comments

Powered by Blogger.